বরিশালের নদী, জোনাকি ছেড়ে তাঁকে পা রাখতে হয়েছে আদিম সাপের মতো ছড়িয়ে। থাকা কলকাতার ট্রামলাইনের ওপর । পৃথিবীর দিকে তিনি তাকিয়েছেন বিপন্ন বিস্ময়ে । বলেছেন সন্ধ্যায় সব নদী ঘরে ফিরলে থাকে অন্ধকার এবং মুখোমুখি। বসবার নাটোরের এক নারী। জানিয়ে দিয়েছেন জ্যোৎস্নায় ঘাই হরিণীর ডাকে ছুটে আসা, শিকারির গুলিতে নিহত হরিণের মতো আমরা সবাই। সস্তা বোর্ডিংয়ে।উপার্জনহীনভাবে দিনের পর দিন কুঁচো চিংড়ি খেয়ে থেকেছেন। তবু পশ্চিমের মেঘে দেখেছেন সোনার সিংহ। পিপড়ার মতো গুটি গুটি অক্ষরে হাজার হাজার পৃষ্ঠা। ভরেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ডায়েরি লিখে। সেগুলোর সামান্য শুধু জনসমক্ষে এনেছেন জাদুকরের রুমালের মতো, বাকিটা গোপনে তালাবন্দী করে রেখেছেন কালো ট্রাঙ্কে। বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় এই মানুষ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে এক নিবিড় বোঝাপড়ায় লিপ্ত হয়েছেন এ সময়ের। শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তার। একজন কমলালেবু উপন্যাসে।
‘এক জীবনের কথা’ উপন্যাসে একজন মানুষের কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে স্বাধীনতা এবং দেশভাগের ইতিহাস। মুখ্য চরিত্রের তারুণ্য রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল দেশভাগের বেদনায়, দাঙ্গার আঘাতে। তারপর কালের প্রবাহে সেই তরুণ পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বিভাগে যোগ দিলেন। মধ্যবিত্তের নীতিবোধের সঙ্গে কর্তব্যের সংঘাত, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা — এসবের মধ্যেই এগিয়ে এল বাংলাদেশের জন্মমুহূর্ত। এক কথায় অনবদ্য একটি বই।
অনাথ বালিকা ফুলবানু বৃদ্ধ হজমি ওয়ালার খোঁজে জয়বাংলা আচার ঘরে ঢুকে পড়ে। উঁচু তাক থেকে একটি বয়াম ধরার সময় ওর হাতটি ফসকে গেলে ভেতরের পুরনো দরজাটি খুলে যায়। বন্দুকের ক্যাট ক্যাট শব্দের সাথে বারুদের গন্ধের ঝাপটা এসে নাকে লাগে। ফুলবানু আবিষ্কার করে এটি একটি যাদুকরী দরজা। এর ভেতর দিয়ে সে অনায়াসে ১৯৭১ সনে যাতায়ত করতে পারে। অন্য কেউ জানতে পারলে দরজার যাদু চলে যেতে পারে ভেবে সে তা গোপন রাখে। দরজার ওপারে, একাত্তরে, সে এক যুবকের দেখা পায়। মুক্তিযোদ্ধা যুবকটি ছিল শত্রুর হাতে বন্দি। পাকিস্তানিরা ওকে ভীষণ অত্যাচার করে। মুক্তি পেতে যুবকটি বালিকার সাহায্য চায়। সাহায্যের খোঁজে বেরিয়ে ফুলবানু পথে যুদ্ধ, পাকিস্তানিদের ধংসযজ্ঞ, এবং অত্যাচারের নমুনা দেখতে পায়। কিন্তু ফিরে এসে দ্যাখে আচার ঘরটির সাথে যাদুকরী দরজাটিও কেউ ভেঙে ফেলেছে। তাহলে কি ফুলবানু আর বন্দি যুবকের দেখা পাবে না? না পেলে তো কেউ ওর যাদুকরী ভ্রমণের কথা বিশ্বাস করবে না। তাই সেই মুক্তিযোদ্ধা যুবকের দেখা ওর পেতেই হবে...।
এমন আনন্দময় বসন্ত কি আর এসেছে এ জীবনে? আগামীকাল সন্ধ্যে থেকে মেলায় থাকবে বই। আমার সন্তানদের গায়ে আমি যেমন করে রাখি আঙুলের ছাপ, এই বইয়ের প্রতিটি শব্দ আমার কাছে ঠিক তাই। আমার অনুভুতিবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, কল্পনার উদর থেকে উঠে আসা ইচ্ছেদের আমি সাজিয়েছি চরিত্রগুলোর মাঝে। শুভ বসন্ত।
কবিতায় মানুষ কী খোঁজে? কেন খোঁজে? রহস্যের স্পর্শ নাকি শব্দ ও অক্ষরের অনুভব। হয়তো অস্পর্শের অনুভবই কবিতা। কবি রাকীব হাসান একজন চিত্রশিল্পী। হয়তো সে কারণেই তার কবিতার অক্ষরগুলো জীবনের রঙে রাঙানো। তার ভাষাভঙ্গি, তার চিত্রকল্প পড়তে পড়তে মনে হল কবিতা ক্যানভাস থেকে উঠে এসে সামনে দাঁড়ায়৷
যাদুর হাওয়া লাগা অনেকগুলো মানুষ, নাগরদোলায় চেপে বসা একটি জনপদ, ঘোর লাগা এক সময়, একটি যুদ্ধ, একজন যুদ্ধাহত কর্নেল, কয়েকটি অভ্যুত্থান। উপন্যাস ‘ক্রাচের কর্নেল; বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় কালপর্বের অনন্যসাধারণ গাঁথা। কর্নেল তাহেরকে নিয়ে লেখা রাজনৈতিক চরিত্রনির্ভর উপন্যাস .
গল্প মানুষের দৈনন্দিন জীবন-আখ্যানের প্রতিফলন ঘটায়। মানব ও সমাজজীবনের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, অনুভূতি বা উপলব্ধিকে উপজীব্য করে এক-একটি গল্পের সৃষ্টি হয়। তবে গল্প বলার ও শোনার ইতিহাস সুপ্রাচীন। মানবসভ্যতার ও ভাষার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে গল্প সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে নিজের স্থান করে নিয়েছে। পরিকল্পনা পর্যায়ে বইটির নামকরণ স্থির করেছিলাম ’অন্যরকম গল্প সংকলন’ কারণ এই বইটিতে একটি গতানুগতিক সংকলন হবে ব্যতিক্রমধর্মী পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। এই গল্পসম্ভারে সমকালীন বাংলার সাহিত্যের কথাসাহিত্যিকদের ছোটগল্প, বড়গল্প, অনুগল্প ও অনূদিত গল্প সহ বহুমাত্রিক আমেজ সমৃদ্ধ লেখকদের এক বা একাধিত গল্প অন্তর্গত হয়েছে।...
তখন আমার শহর জুড়ে রাত্রির নিস্তব্ধতা। হঠাৎ সকল নীরবতা ভেঙে আপনি আবার কথা বলতে শুরু করলেন, সেই একই গল্প। আপনার ভীষণ একা লাগে। কোথাও শান্তি মেলে না। কোথাও স্বস্তি মেলে না। কথাগুলো শুনে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি, পৃথিবীতে মানুষের মন সবসময় আশ্রয় খুঁজে ফেরে। কেউ আশ্রয় পায়। আর কারো পাওয়া হয় না। তবুও এই শহরের রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে ও একটি কথা বলা হয় না, আপনি, আমি, আমরা সবাই একা।
অবাসযোগ্য এই পৃথিবীর বেড়ে চলা ‘ক্ষুধা আর ক্ষুরধার নীতির সংকট’, যা ভোগায় আমাকে গুলিবিদ্ধ পাখির যন্ত্রণাকাতর কন্ঠের মতোন। চঞ্চল করে তোলে, যখন হঠাৎ বাতাসের এক হলুদ গনগনে আভায় উচ্ছ্বল সবুজ ঘাসফড়িং’রা হয়ে পড়ে নীল নিথর। কিন্তু এ পৃথিবী তো হতে পারত নিরাপদ, হতে পারত অন্নপূর্ণার আলো। ধরিত্রীর প্রতিটি শস্যকণা একইভাবে প্রবেশ করতে পারত প্রতিটি উদরে। এ পৃথিবী হতে পারত প্রেমের, হতে পারত তীব্র চুম্বনের, নারীর ভেজা চুলে হেলে পড়া নরম দুপুরের, হতে পারত নগ্ন পায়ের সাদা জুতোর। এ পৃথিবী হতে পারত তাদের, যারা বিশুদ্ধ ভালোবেসে তোমাকে জিতিয়ে দিয়ে হয়েছে ‘হারিয়ে যাওয়া শেরপা’। আমাদের কি ঠিক অতোটা জেতবার দরকার আছে? প্রাণপণ ছুটে সকলকে মাড়িয়ে বাতাসের ঠিক অতোটা উচ্চতায় যাবার? যেখানে গেলে ফুরিয়ে যায় অক্সিজেন আর ফুরিয়ে যাই আমরা নিজেই। বরং আমরা পৌঁছাতে পারি সেখানে, পৃথিবীর আদিমতম দিন থেকে যেখানে আমাদের এক হবার হাহাকার। হাহাকার এক অমিমাংসিত মেঘ থেকে বৃষ্টি নামানোর, হাহাকার ছুটি হয়ে যাওয়া একলা হোস্টেলের ধূসর নিভৃত সন্ধ্যের। সেই এলোমেলো ভাবনার- গোপন কান্নার, সাদা-কালো অক্ষরে পুষে রাখা ক্ষতের জলছাপ এই কাব্যগ্রন্থ।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থার আলোকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের তুলনা করে ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে লেখা কয়েকটি রস-রচনা। এর কোনোটি গল্পের আকারে বলা প্রবন্ধ, কোনোটি প্রবন্ধের আকারে বলা গল্প, আবার কোনোটি গল্পের কাঠামোয় লেখা বৈজ্ঞানিক তথ্য। অথচ প্রতিটিতেই রসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গভীর চিন্তার খোরাকও প্রচ্ছন্ন। তাই পড়া শেষ হয়ে গেলেও পাঠকের মনে তার রেশ রয়ে যায়। যে-লেখাগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো পাঠকরা সাদরে গ্রহণ করেছেন ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। পাঠক-সমালোচকরা এক কথায় লেখাগুলোকে ‘বৈজ্ঞানিক গলপ্রবন্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রচলিত সংজ্ঞায় বইটিকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বলা যেতে পারে।
পুরো বইটি জুড়েই তো শুধু চলার গল্প। বইটিকে কী বলব? উপন্যাস? নাকি পরিব্রাজকের আত্মকথন? জানি না। কিন্তু বইটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, অনেক অনেক মানুষের পড়া দরকার এমন বই। লেখক তো কোনও সমাধান বাতলে দেবার চেষ্টা করেননি। নিজের মত চাপিয়ে দেননি। বরং একটা খেলা খেলেছেন। প্রশ্নের খেলা। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করা আর উত্তর খোঁজার খেলা। পথ চলা তো আসলে একটা খেলাই। তবে ছেলেখেলা তো নয়। এই বইটি আসলে পথ চলার গল্প। চলতে শেখার দর্শনবোধের গল্প।
এই পাঁচটি বছরে প্রতিবারই প্রকৃতিতে ফাগুন এসেছে, বসন্তও এসেছে— জানো তো? ফাগুন মাসেই জন্মেছিলাম কিনা, তাই ফাগুনকে ভুলতে পারি না। শুধু সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা পাইনি— একটি বারের জন্যও না; মনেও করেনি সে। —এভাবে বলো না, প্লিজ! —তা ঠিক, এভাবে বলে আর কী লাভ? কিন্তু খুব মিস করি, জানো? বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, ‘আজও মনে আছে তোমার?’ —থাকবে না কেন? আমি তো কিছু ভুলতে চাইনি। চাইলে হয়তো ভুলে যেতাম।