হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো একটি সূক্ষ্ম পুষ্পরেণুও কোনো কোনো মানুষের দৃষ্টি এড়ায় না। সবুজ ঘাসের পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু আর অবাক মেঘের উড়ানে কেউ কেউ খুঁজে পান জীবনের সুন্দরতম অবয়ব, নিজের পরিপাটি ভুবন রেখে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন সময়ের ঘাত-প্রতিঘাত। মানুষের দৃষ্টিসন্ধিতে জমে থাকা পরশপাথরও চুর চুর করে ভেঙে পড়ে তার জাদুকরী আঙুল স্পর্শে। তেমনই অন্তদ অন্তর্দৃষ্টি আর মমতায় জীবনের গল্প রচে চলেন গল্পকার স্মৃতি ভদ্র। পালক নরম শব্দের বুনন, দুর্দান্ত কল্পনাশক্তি আর নিগূঢ় মমত্ববোধ দিয়ে গল্পকার স্মৃতি ভদ্র 'এলেনা বেলেনা' গল্পগ্রন্থের ষোলোটি গল্প নির্মাণ করেছেন। এই গল্প- সংকলনের গল্পগুলোতে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের নানা অবক্ষয় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
এই কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেকটি কবিতা, তসবিদানার মতো এক সুতায় গাঁথা । কাছাকাছি সময়ে লেখা । এজন্য কবিতাগুলোর আর আলাদা ভাবে নাম দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। তবে বৃষ্টি বা নদীর বয়ে যাওয়া পানির মতো একের পর এক কবিতা মিল রেখে সাজানো। আমার আগের সব কাব্যগ্রন্থ যেমন, এই গ্রন্থ সেরকম নয়, ব্যতিক্রম। মূলত এখানে আছে একটি কাল্পনিক প্রেমের অভ্যর্থনা, আলাপ, পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা এবং তার শেষ পরিণতির উপাখ্যান। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে, এমনটাই দেখতে পাবেন কবিতাগুলোর সর্বাঙ্গে ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেই ধীরে ধীরে বিদেশে যেতে শুরু করে বাংলাদেশীরা। মানুষ যখন বিদেশে যায়, বাইরে যাবার একটা চিন্তন। ডাকত থাকেই, থাকে আমন্ত্রণ ও প্রয়ােজন। কারও কারও থাকে দেশভ্রমণের নেশা। বাংলাদেশী এই প্রায় পঞ্চাশ বছরে, পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আজ এক কোটির উপরে। বেশির ভাগই স্থায়ীভাবে বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। দেশ ভিন্ন হলেও, এদের পরিচয় বিশ্ববাঙালি। দেশ ভিন্ন কিন্তু ভাষা এক, 'বাংলা'। ভিন্ন সংস্কৃতি, কিন্তু ঘরে-বাইরে-অন্তরে, জাগরণে-নিদ্রায় বাংলা-বাস সর্বসময় বিপুলভাবে সংবেদনশীল হয়ে রয়। বাংলার সরােবর অতল ও বিশাল এবং উষ্ণ প্রবাহে চঞ্চল। চঞ্চল উত্তর আমেরিকাতেও। স্বাধীনতার পরপর আমেরিকায় বাংলাদেশির আগমন হাতে গােনার পর্যায়ে থাকলেও, আশির দশকের শেষের দিকে দলে দলে, বিভিন্ন কারণে ও কৌশলে, এ দেশে আসতে শুরু করে। তারপর নব্বইয়ের গোঁড়ায় আগমন-আগলটি অনেকটা পুরােপুরিই খুলে যায়। একেবারে শুর দিকে যারা এসেছেন তাদের যাত্রাপথের সংগ্রহে ছিল সংশয় আর নিঃসঙ্গতা; ভিন দেশে টিকে থাকার কৌশল অজানা; ভিন ভাষা তখন শুধু শব্দ দেয়, কোনােপ্রকার ভাব প্রদান করে না। কিন্তু, যেহেতু সে জানে তার আকুতি-বিকুতির ভাষা রক্তস্নাত, ভাষা-সংগ্রামের মাধ্যমে সে চিনে নিয়েছে জীবন সংগ্রামের পথ, সেহেতু, বুকের আরশিতে প্রতিক্ষণ জ্বলে ওঠে সেই ভাষা মর্মে ও বর্ণে, ‘সাহস' হয়ে ওঠে তখন তার তাৎক্ষণিক অস্ত্র, মােকাবেলার। প্রতিকূলতার কাছে আপাত বিবেচনায় সে দুর্বল হলেও, তার বাঁচার জিজ্ঞাসা, বিস্ময়, আশী, সংস্কৃতির-প্রভেদঅভিব্যক্তি রূপান্তরিত হয় সংগ্রামী অভিনিবেশে। বৈরী পরিবেশে এই অভিনিবেশ বেঁচে থাকে প্রতিনিয়ত।
দবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “সাত ব্যক্তি আরশের ছায়ায় আজ আশ্রয় পেয়েছে। এদের মধ্যে ওসব লোকও আছে যাদেরকে কোন সুন্দরী মেয়ে লাগানোর জন্য আহ্বান করেছিলো। কিন্তু তারা আল্লাহর ভয়ে যায়নি। যৌবনকালে আমাকেও এমন করেছিল এক সুন্দরী!” ত্বহা উৎসাহের সাথে জানতে চাইলো, “তারপর? আল্লাহর ভয়ে বিরত ছিলেন?” দবির মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, “না রে ভাই। আমাকে আর দ্বিতীয়বার বলা লাগেনি। এক লাফে কম্বলের তলে। দেখছেন না গোড়ালি ডুবে গেছে ঘামে।” ত্বহা ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো। সমতল ভূমি। অথচ কোথাও লোকের গোড়ালি পর্যন্ত ঘাম। কোথাও কোমর পর্যন্ত। কেউ কেউ তো ঘামে সাঁতার কাটছে। গলা পর্যন্ত ঘাম তাদের। অথচ সবটাই সমান। বিজ্ঞান আজ কোথায়? আর থাকতে না পেরে গেয়েই উঠলো সে, “আল্লাহর কী কুদরত! লাঠির ভেতর শরবত!” প্রথম যে লোকটা কথা বলেছিল সে এটা শুনেই হাততালি দিয়ে ফেললো, “আখ। ইক্ষু। সুগারক্যান। তাই না?” মাথা দোলালো ত্বহা। “আপনার ইংরেজি তো চমৎকার! নামটা জানা হলো না।” লোকটা হাততালি দিতে দিতে বললো, “আমি? আমি তো শাকিব খান। নাম্বার ওয়ান, শাকিব খান। আসলে আমার নাম মাসুদ রানা। দুনিয়াতে থাকতে শাকিব খান নামে চলতাম। সিনেমার নায়ক।” ভ্রু কুঁচকে গেল ত্বহার, “আপনি-ই তো সেই ফাদার ফিগার, রাইট?” একটা আঙুল তার দিকে পিস্তলের মতো তাক করলো শাকিব খান, “রাইট ইউ আর!” --- হাশরের ময়দানে দবির নিজেকে আরও কিছু উদ্ভট মুসলমানের পাশে আবিষ্কার করলো নিজেকে। একটু পর যে মহাশ্চার্য বিষয়টি আবিষ্কার করবে – সে বিষয়ে কোন ধারণাই তার ছিল না। “নাস্তিক শিকারী” গল্পটি সংকলনের অন্যতম সেরা গল্প। পিছিয়ে নেই বাকি গল্পগুলোও। পাঠককে পড়ার আমন্ত্রণ।
জালালুদ্দীন রুমির দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে, সকল সৃষ্টি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং সকল অস্তিত্বের মূল হলো ‘প্রেম’। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের জীবনের লক্ষ্য হলো আল্লাহ এবং সকল সৃষ্টির সঙ্গে আমাদের একত্ব উপলব্ধি করা। যাযাবর স্বভাবের দরবেশ ও আধ্যত্মিক শিক্ষক শামস তাবরিজীর সঙ্গে রুমির প্রেমময় সম্পর্ক তাঁর জীবনে রূপান্তর ঘটিয়ে তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে এবং তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে প্রেমের আনন্দ ও বিচ্ছেদের যন্ত্রণার ওপর অত্যন্ত চমৎকার অন্তর্ভেদী কবিতা রচনা করতে। তিনি প্রেমকে বিশ্বের প্রচণ্ড শক্তি ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের চাবিকাঠি হিসেবে দেখেছেন। তাঁর কাছে প্রেম কেবল একটি অনুভব নয়, বরং সচেতনতার অবস্থা, আনন্দ ও বিষাদসহ সবকিছুর কাছে আমরা উন্মুক্ত। তিনি বলেছেন, “আমি আল্লাহর কাছে এত কিছু শিখেছি যে, আমি নিজের বাইরে আর কিছু সন্ধান করি না। সবকিছু আমার মাঝে, মহাবিশ্ব আমার মাঝে।”
কাউকে যদি ভ্রমণের নেশায় পেয়ে বসে, তাকে ঘরে আটকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, মার্কো পোলো, হিউয়েন সাং, নিকোলাও মানুচিসহ বিশ্ব পরিব্রাজকের ভ্রমণকাহিনি পাঠ করে তাদের সময়ের বিশ্ব সম্পর্কে আমরা ধারণা লাভ করেছি। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় তাদের মতো অবাধে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নেই। ভ্রমণের ইচ্ছা জাগলেও হুট করে কোথাও যাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যোগাযোগ, দেশে দেশে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়, বাণিজ্যিক সম্পর্ক, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের সম্প্রসারণ এবং পর্যটন-ব্যবসা বিকাশে ভিন্ন অর্থে ভ্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশে আমি বেশ কিছু দেশ ভ্রমণের সুযোগ লাভ করেছি। কোনো কোনো দেশে আমাকে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘসময় অবস্থান করতে হয়েছে, যার ফলে ভিন্ন দেশ ও সমাজকে জানার যে সুযোগ পেয়েছি তা পাঠককে জানানোর চেষ্টা করেছি ‘ও আকার ও বিহঙ্গ’ নামে আমার ভ্রমণকাহিনিতে। আমার কোনো কোনো ভ্রমণবৃত্তান্ত সাড়ে তিন থেকে চার দশক আগের, যখন বিদেশ ভ্রমণ বর্তমান সময়ের মতো সহজ ছিল না— সেই পিছিয়ে থাকা সময়ের চিত্র কল্পনা করে আমার ভ্রমণকাহিনি পাঠ করলে পাঠকের কাছে উপভোগ্য হতে পারে।