জাপান-বাংলা সম্পর্কের ইতিহাসে একজন। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন যশোর জেলার মথুরাপুর গ্রামের মন্মথনাথ ঘোষ (১৮৮২-১৯৪৪)। নলডাঙ্গার রাজা প্রমথভূষণ দেব রায়ের আর্থিক সহযোগিতায় চিরুনি ও বোতাম তৈরি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি জাপান যান। রওনা দেন ১৯০৬ সালের ১ এপ্রিল। আর তার জাপান বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ জাপান-প্রবাস প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। জাপানের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি আরো রচনা করেন নব্য-জাপান ও সুপ্ত-জাপান। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান ভ্রমণের পূর্বে হরিপ্রভা তাকেদার বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রাকে বাংলা ভাষায় রচিত জাপান সংক্রান্ত প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ মনে করা হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় এটি সুস্পষ্ট যে হরিপ্রভার পূর্বে বহু বাঙালি জাপান ভ্রমণ করেছেন এবং জাপান বিষয়ে গ্রন্থও রচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে মন্মথনাথ ঘোষ বিশেষ গবেষণার দাবীদার। জাপান-বাংলা সম্পর্কের ইতিহাস শতাব্দী পার করেছে। শতবর্ষের ইতিহাসটাকে পূর্ণ আলোয় ধরার চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য। তা না হলে আমাদের নিজেদের অতীত হয়ে পড়বে খণ্ডিত। যা কোন স্বাধীন জাতির কাম্য হতে পারে না। দীর্ঘকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা শতবর্ষ প্রাচীন এ গ্রন্থটির পুনঃপ্রকাশ নিঃসন্দেহে জাপানের সাথে বাংলাদেশ তথা বাঙালির ইতিহাসের নতুন দ্বার উন্মোচনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
শিক্ষা এবং সাহিত্য আধার আধেয় উভয় বৈশিষ্ট্যেই স্বতন্ত্র। শিক্ষা বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা প্রসঙ্গে মনীষীদের ভাবনাসহ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্ভাব্য সকল দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষিত হয়েছে এ গ্রন্থের 'শিক্ষা অংশে। ইংরেজি শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ইতিবাচক দিক, ইংরেজি শিক্ষাদানে রবীন্দ্রনাথের সরলীকৃত পদ্ধতি এবং জীবনানন্দ দাশের যুগোপযোগী শিক্ষাচিন্তার শিল্পসম্মত মেলবন্ধন ঘটেছে এতে। অগোচরে পড়ে থাকা মেধাবী কথাকার সাবিত্রী রায়, সুলেখা সান্যাল ও লোকনাথ ভট্টাচার্যের সাহিত্যকর্মের সযত্ন পরিচর্যা; উপন্যাসের কথক প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিকের ভাবনা; সতীনাথ ভাদুড়ী, মিরজা আবদুল হাই, আহমদ ছফা এবং বিজন শর্মার প্রতিনিধিত্বশীল উপন্যাসের বিশ্লেষণ; এবং সর্বোপরি ইন্টারনেটে বাংলা সাহিত্যের দুরবস্থার অন্বেষণ এ গ্রন্থের সাহিত্য অংশের আলোচ্য। সর্বশেষ প্রবন্ধটি অনলাইনে বাংলাদেশের সাহিত্যের দারিদ্র্য দূরীকরণে লেখকের ব্যক্তিগত পদক্ষেপের খতিয়ানে হয়ে উঠেছে সমুজ্জ্বল।
শ্রীচৈতন্যদেব ২০০৪ সালে বিবিসি-র সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি যে বিশজনের নাম নির্বাচিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে শ্রীচৈতন্যদেবের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রধানত ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকাতেই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক মানুষ কর্তৃক তার অবদান খানিকটা হলেও অগ্রাহ্য হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মজার বিষয় হলো বাঙালির গত সহস্র বছরের ইতিহাসে অন্যতম যে মানুষটি ব্যক্তিজীবনের সকল ধর্মীয় সংস্কারকে ভেঙে ফেলতে পেরেছিলেন, সমাজের বিরাট অংশকে আলোড়িত করেছিলেন এক দশক ধরে, যে আলোড়নের ঢেউ পরের দুই শতক জুড়ে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে অবাঙালি প্রান্তরেও আছড়ে পড়েছিল সেই মহামানব হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। বিশ শতকের পুরোটা জুড়ে তার হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র শান্তির বার্তা পৌঁছেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। আর তাই ভারতবর্ষের সীমানার বাইরে যে কোনো বড় শহরে বাঙালি যে মানুষটি পরিচিত তিনি হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে একই তলে বিবেচনা করার ঔদ্ধত্য নিয়ে আর কোনো বাঙালি সম্ভবত জন্মগ্রহণ করেননি। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য, বাংলাভাষী অঞ্চলে প্রচারিত সংগীত ও নৃত্যে শ্রীচৈতন্যের বিশাল অবদানের কথা নতুন নতুন প্রজন্মে বাঙালি স্মরণ করতে বাধ্য। তবে তার শ্রেষ্ঠত্ব সম্ভবত ছিল তার নেতৃত্বগুণ এবং সাংগঠনিক দক্ষতায়। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন ও কর্ম নিয়ে একবিংশ শতাব্দীর নতুন প্রজন্মের লেখকের মূল্যায়ন পাঠককে নতুন করে এই যুগপুরুষকে জানতে সহায়তা করবে বলেই বিশ্বাস।