১৯৬৪ সালে দাঙ্গার শিকার হয়ে সপরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মানস। জন্মভূমির প্রতি জন্মেছিল ঘৃণা, মুছে দিতে চেয়েছিল তার সব স্মৃতি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সে নিউইয়র্কে, জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। সেখানে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায় এই নিজের জন্মভূমির ভাগ্য নিয়ে বৃহৎ শক্তিসমূহের দড়ি-টানাটানি। নিজের অজ্ঞাতেই সে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ে দেশটির মুক্তি আন্দোলনে। উপলব্ধি করে রাজনীতি ও মানচিত্রের বিভেদে ছিটকে পড়লেও জন্মভূমির সঙ্গে তার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। ভাঙতে থাকে মানবিক সম্পর্কের ভুল-বোঝাবুঝি। আন্তর্জাতিক পটভূমিকায় রচিত হাসান ফেরদৌসের প্রথম উপন্যাস মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরই এক প্রামাণিক কাহিনি।
" পাকিস্তানী শাসনের শেষ কয়দিনে ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশায় জেনারেল রাও ফরমান আলী জড়িত ছিলেন কিনা এবং থাকলে কতখানি জড়িত ছিলেন তার তদন্ত হয়নি। তবে তদানীন্তন পাকিস্তানী সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান হিসাবে তার জড়িত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই বাঙালীর কাঠগড়ায় রাও ফরমান আলী কতখানি অপরাধী সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অপমানজনক পরাজয় বরণ করার জন্যে পাকিস্তানী জনগণের কাঠগড়ায় তখনকার জেনারেলদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেই অপরাধ ও অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পেতে অনেক জেনারেলই আত্মজীবনীতে একাত্তরের যুদ্ধে নিজেদের দোষ ও ভুল-ত্রুটিগুলো ঢাকতে এবং সাফাই গাইতে চেষ্টা করেছেন। রাও ফরমান আলীও তার ব্যতিক্রম নন। এসব লেখায় তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক ঘটনাই এসেছে এবং জেনারেলরা নিজেদের সুবিধামতো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে সব কারণে পাকিস্তান হেরেছিল, সেসব অনেক ভুল ও দোষ পরস্পরের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। জেনারেল রাও ফরমান আলীর How Pakistan Got Divided বইটি রচনাশৈলী বিন্যাসের দিক থেকে অন্য জেনারেলদের চাইতে অনেক উন্নত। বইটি তিনি কেন লিখেছেন এ সম্পর্কে রাও ফরমান আলী খানের ভাষ্য, “অন্য অনেকে যা দেখেছেন বা দেখতে পেয়েছেন, আমি তার চেয়ে অনেক বেশী দেখেছি।” কী দেখেছেন রাও ফরমান আলী খান? বইটিতে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা কতখানি সত্য? রাও ফরমান আলীর ভাষ্য অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসভাজন মনে হবে। এ কৌশল তাঁর জন্য অবশ্যই ভালো। কিন্তু ইতিহাস বা ভবিষ্যতের জন্য তা ভয়ঙ্কর। পাকিস্তানের জনগণ অথবা অন্যান্য দেশের পাঠকের বইটি পড়ার সুযোগ হলেও বাংলাদেশের জনসাধারণের হয়তো সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এই বইটিতে রাও ফরমান আলী যুদ্ধের নীতি নির্ধারণে পাকিস্তানী পক্ষের শক্তি হিসাবে কাজ করার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হারার বিষয়ে কীভাবে সাফাই গাইছেন পাঠক তা খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হতে পারবেন। অনূদিত এই গ্রন্থটিতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর দীর্ঘ ভূমিকায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, এ বই থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন জেগে উঠবে, বেরিয়ে আসবে অনেক সত্য। অগোচরে থেকে যাওয়া ইতিহাসের সে সকল সত্য নিয়ে রচিত হবে প্রকৃত ইতিহাস। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, রাও ফরমান আলী খানের উপস্থাপিত তথ্যের চ্যালেঞ্জ করার জন্য অনেকে এগিয়ে আসবেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের উপাত্ত উপাদান ও গবেষণা হয়ে উঠবে আরো সমৃদ্ধ। আখতার আহমেদ বীর প্রতীক"
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মাটিতে হলেও সে যুদ্ধের আড়ালে রয়েছে অনেক যুদ্ধ যা সংঘটিত হয় বাংলার মাটি থেকে দূরে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, অথচ কত জানা-অজানা মানুষ সে যুদ্ধে আমাদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছে। এই গ্রন্থে রয়েছে সেই সব কিছু জানা-অজানা মানুষের কথা। রয়েছে সেই যুদ্ধের পেছনে যুদ্ধের কিছু কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে, জানুয়ারি ১৯৭১-এ একটি ভারতীয় বিমান হাইজ্যাকের কাহিনি দিয়ে এই গ্রন্থের শুরু। আমরা সেই হাইজ্যাকের কথা অনেকেই মনে রাখিনি, কিন্তু সমর কৌশলবিদেরা একমত, সেই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। এছাড়াও রয়েছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে সােভিয়েত কূটনীতিক ইয়াকভ মালিকের সাহসী ভূমিকার বিবরণ, বাংলাদেশের গণহত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাডের প্রতি একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি, একাত্তরের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের একটি সাক্ষ্যভাষ্য ও মার্কিন নৌ-বন্দরে পাকিস্তানি অস্ত্রবাহী জাহাজ অবরােধের অবিশ্বাস্য কাহিনী।