দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাপানের বিখ্যাত লেখক টুছিয়া ইউকিয়ো (১৯০৪-১৯৯৯) রচনা করেন এ গ্রন্থ। ছবি আঁকেন মোতোইছিরো তাকেবে (১৯১৪-১৯৮০)। লেখক তিনটি হতভাগ্য হাতির মৃত্যু কাহিনির মাধ্যমে বর্ণনা করেন যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা।
নাওমি ওয়াতানাবে জাপানের মানবতাবাদী লেখক। তিনি জাপানের নিইগাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স প্রােগ্রামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও এর ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে প্রচুর আগ্রহ ও ভালােবাসা থাকায় দীর্ঘদিন এদেশে থেকেছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন বাংলাদেশকে। সুমিও এবং সুমন গল্পে লেখক অত্যন্ত মমতা মাখা ভাষায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষার প্রতি সুমিও নামের এক জাপানি কিশােরীর গভীর ভালােবাসার কথা তুলে ধরেছেন। সুমিওর ভেতর এই ভালােবাসা তৈরি করে দিয়েছে তাঁর নানি সুমিকো-সান। তিনিও স্বাধীনতার আগে এদেশে নার্সের কাজ করেছেন। তখন থেকে তিনি খুব কাছ থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই গল্পে সুমিও তার প্রতিবেশী বন্ধু সুমনকে বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে দেশকে ভালােবাসতে হয়, এর মানুষকে ভালােবাসতে হয় আর ভালােবাসতে হয় মায়ের ভাষাকে। এই গল্পে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলাে, মা, মাতৃভাষা, মুক্তিযুদ্ধ এই তিন একই সুতােয় গাঁথা।
বইটির কিছু অংশঃ ম্যাজিক আওয়ার (Magic Hour): আজকেও মিকা তার সাথে সমুদ্রতীরে এসেছিল। প্রতি সপ্তাহের শেষে মিকা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সমুদ্রতীরে হাঁটতে যায়। হাঁটার সঙ্গী হলো শ্বশুর বাড়ির একটা জীর্ণ-শীর্ণ কুকুর। কুকুরটির নাম মুকুর, এখন তার বয়স ২০ বছর। মুকুরের সাথে মিকার প্রথমে পরিচয় হয়েছে ৫ বছর আগে, এক বসন্তের দিনে। বিয়ের আগে যখন মিকা তার হবু স্বামী রিকির বাড়িতে প্রথমে বেড়াতে গিয়েছিল, তখন বয়স্ক কুকুর মুকুর বাড়ির ছোট বাগানে ঘুমাচ্ছিল। সে নিষ্প্রাণভাবে এক নজর মিকাকে দেখে আবার ঘুমাতে শুরু করল। মুকুরের গায়ের ঝোপের মত চুলগুলো ছিল এলোমেলো, চাকচিক্যহীন, দেখতে অতিক্লান্ত। বাগানে দেখা যাচ্ছিল বিভিন্ন রঙের বসন্তের ফুল। শীতকালে তুষার আবৃত মাটির নিচে ধৈর্য ধরে তারা বসন্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। এখন তারা বসন্তের কোমল আলো ও মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে মিশে আনন্দে দুলছিল। এমন জীবন্ত দৃশ্যর মধ্যে একটা শীর্ণ কুকুর। এই বৈসাদৃশ্যর জন্য মিকা মনে মনে হাসল।
নাওমি ওয়াতানাবের বাংলাদেশের জীবন সংগ্রাম ও তার দেখা বাংলাদেশের নানারকম দৃশ্য 'যাপিত জীবনে আমার বাংলাদেশ" বইয়ে অংকিত হয়েছে। একজন বিদেশী নারীকে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি হাসপাতালে সরাসরি নিযুক্ত করা হয়েছে। এবং সে পরিবার দেশে রেখে একা বাংলাদেশে ৫ বছর বাস করেছে। এই পরিস্থিতি এবং অকল্পনীয় কঠোর দৈনন্দিন জীবন থেকে পাওয়া বাংলাদেশের নানারকম ধারণা ও তার অভিজ্ঞতা এই বইতে প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ের কাহিনীর চরিত্র হলো দিনমজুর, ৩ নম্বর বাসের কন্ডাক্টর, শিশু দোকানী ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনের জন্য সংগ্রাম করা মানুষরা। নাওমি ওয়াতানাবে তাদের সুখ ও দুঃখের দৃশ্য ধীরস্থিরভাবে দেখেছে। নাওমি ওয়াতানাবের দৃষ্টির মধ্যে আছে একজন সাধারণ মানুষের মানব প্রেম। তাছাড়া বইতে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের হাসপাতালে কাজ করা অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম, নিজের ওজন কমানোর অভিজ্ঞতা, পুষ্টিগত পরামর্শ, বাংলা গানের জন্য ভালোবাসা, রেওয়াজ ইত্যাদি। সাথে সাথে বর্তমান জাপানের কিছু মজার বিষয়ও এই বই থেকে পাওয়া যাবে। আর মানবতাবাদী লেখক নাওমি ওয়াতানাবে হৃদয়ের উষ্ণউত্তাপ ছড়িয়ে আছে এ বইয়ের পাতায় পাতায়।
জাগান আর বাংলাদেশ। সমাজ ও সংস্কৃতিতে স্বতন্ত্র। পরস্পর দূরত্ব সুস্পষ্ট। তবে মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে আছে যে প্রণয়তৃষ্ণা, মানুষকে ব্যকুলতায় অস্থির করে যে স্নেহকাতরতা, মানুষকে পীড়ন করে যে হিংসা-দ্বেষ, তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই জাপানি মানুষ আর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে। এই দুই দেশের মানুষের জীবন ও জীবন ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে প্রতিবেশীগণ, সহযাত্রী, বাবার দায়িত্ব, কোকিল, গোয়েন্দা, নদীতীরের অ্যালবাম ইত্যাদি গল্পে। গল্পকার নাওমি ওয়াতানাবে এ সকল গল্পে জীবনকে দেখেছেন কখনো জাপানির চোখে আবার কখনো বাঙালির চোখে। তবে সকল সময় তার মন ছিল মানুষের পক্ষে এবং মানবতার প্রতি উচ্চকিত। 'প্রতিবেশীগণ' গল্প গ্রন্থে নাওমি ওয়াতানাবে গল্প বলেননি। বলেছেন জীবনের কথা। স্বপ্ন ও সুন্দরের কথা।