জনসংখ্যার অনুপাতের বিচারে ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম সংখ্যা স্বল্প হলেও বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান ছিল অনেক বেশি। ভারতের ইতিহাসই এর সাক্ষী। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের বহু আগে থেকে ভারতের বহু মুসলিম শাসক ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়ে শাহাদাত বরণ করেছেন। এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনও আলেম সমাজসহ ভারতীয় মুসলমানদের বড় অংশ দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে অখণ্ড ভারতের পক্ষে অটল ভূমিকা পালন করেছেন। বইটিতে দেশের জন্য ভারতীয় মুসলমাদের অবদান তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতায় জিতে ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ এম জে আকবরের বিশ্লেষণ-ভিত্তিক গ্রন্থ ‘গান্ধী’স হিন্দুইজম: দ্য স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট জিন্নাহ’স ইসলাম’ এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করতে যাচ্ছে সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘নালন্দা’। অন্যান্য যেসব প্রকাশনা সংস্থা বইটির অনুবাদ প্রকাশের আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির পূর্ব পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের জাতির পিতা যথাক্রমে মোহনদ্াস করমচাঁদ গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলনে শরীক অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের ভূমিকার ওপর তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘গান্ধী’স হিন্দুইজম: দ্য স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট জিন্নাহ’স ইসলাম’ । বইয়ের শিারোনামই বলে দেয়, লেখক অবিভক্ত ভারতের পক্ষে গান্ধীর অবস্থানকে উর্ধে তুলে ধরেছেন এবং জিন্নাহকে তুলোধূনা করতে ছাড়েননি। মানুষের সমালোচনা থেকে কেউ রক্ষা পায় না। সৃষ্টিকর্তা, তিনি আল্লাহ হোন, ইশ্বর বা ভগবান হোন -- তারাও মানুষের সমালোচনা, হাসি-মস্ক‹রার পাত্র। তাদের প্রেরিত নবী-রাসুল, অবতাররা সমালোচনার উর্ধে নন। অতএব গান্ধী ও জিন্নাহ তাদের পক্ষ-বিপক্ষের দ্বারা প্রশংসিত ও সমালোচিত হবেন, এটাই স্বত:সিদ্ধ। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অহরহই দেখা যায়, গতকাল যারা একজনের মাথায় ক্ষমতার রাজমুকূট পরিয়েছেন, আজ তাকে মসনদ থেকে টেনে নামাচ্ছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি ভারত বিভাগ মেনে নিতে পারি না। কোনো রাষ্ট্রের কোনো বিভাজন মেনে নিতে পারি না। আমি ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যে’ (ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি) বিশ্বাস করি। এটি নতুন বা আধুনিক যুগের ধারণা নয়। সূফি দার্শনিক ইবন-আল-আরাবি (১১৬৫-১২৪০) বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণা দিয়েছেন, যাকে তিনি বলেছেন ‘ওয়াহদাত আল-ওয়াজুদ’ অর্থ্যাৎ ‘সত্তার ঐক্য’। অর্থ্যাৎ ‘সেই বাস্তবতা এক, আল্লাহ বা ইশ্বরের অস্তিতই একমাত্র সত্য, অন্যান্য সবকিছু ছায়া, আল্লাহ গুণাবলীর প্রতিফলন মাত্র। আল-আরাবির দর্শনকে সার্বজনীন রূপ দিয়েছেন আবদ আল-করিম আল-জিলি (১৩৬৬-১৪২৪), যিনি বলেছেন, ‘আল ওয়াহদাহ ফিল-কাসরাহ ফিল-ওয়াহদাহ’ অর্থ্যাৎ বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র’। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিরা আরও চমৎকারভাবে ‘ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’কে বিশ্লেষণ করেছেন। এম জে আকবরের গ্রন্থের প্রতিপাদ্যও তাই। এই গ্রন্থে ব্রিটিশের কবল থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং মাত্র ২৪ বছর পর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পাকিস্তান তত্ত্বের অসারতার কথাও বলা হয়েছে। সাধারণ পাঠক ছাড়াও রাজনীতিবিদ, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষকদের অবশ্য পাঠ বই বলে আমার বিশ্বাস।