"এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে তুমি কীভাবে করো স্বাধীনতাবিরোধীদের সংগঠন?’ ‘স্যার, আমি করি না। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে যে শাস্তি দেন মাথা পেতে নেব।’ প্রক্টর স্যার হুংকার দিয়ে ওঠেন। ‘কী প্রমাণ চাও তুমি? তোমার ফোন পরীক্ষা করেছে ছেলেরা। অবশ্যই তুমি স্বাধীনতাবিরোধীদের লোক।’ আমি চিৎকার করে উঠি, ‘এসব সত্যি না, স্যার।’ ‘তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করো! আবার তোমার এত বড় সাহস, তুমি ফোন করো আমাকে!’ ‘স্যার!’ আমি কেঁদে ফেলি এবার। ‘তাহলে কার কাছে যাব, স্যার?’ তিনি তিক্ত কণ্ঠে পাকিস্তানের নাম বলেন, সেখানে চলে যেতে বলেন। পাকিস্তানের সাথে আমার কী সম্পর্ক, কেন সেখানে যাব, কিছুই বুঝতে পারি না। বিস্মিত হয়ে বলি, ‘কই যাব, স্যার!’ ‘পাকিস্তান! পেয়ারা পাকিস্তান!’ নাটুকে ভঙ্গিতে এটা বলেই তিনি ফোন কেটে দেন। আমি আবু বকর এই সময়ের বিব্রতকর কাহিনি। "
মার্কিন কথাসাহিত্যের বরপুত্র আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন একাধারে নন্দিত ও নিন্দিত। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই মানুষটি দুটি বিশ্বযুদ্ধই প্রত্যক্ষ করেন। প্রথমটিতে মারাত্মক আহত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান তিনি। পরবর্তী জীবনে দুবার বিমান দুর্ঘটনায় নিজের ও স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পড়েছেন সংবাদপত্রে। অ্যাম্বুলেন্সচালক ও সমর সাংবাদিক হিসেবে রণক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে শিকার, মুষ্টিযুদ্ধ, ষাঁড়ের লড়াই, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরাসহ নানা দুঃসাহসিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন বয়সী নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন, পরবর্তী জীবনে যাঁদের মধ্যে ছিলেন এক আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীও। বিভিন্ন সময়ে একাধিক পক্ষের হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনি গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন, প্রমাণিত ও অনুমাননির্ভর এমন ভূমিকার কথাও উপেক্ষা করা যায় না। তাঁর প্যারিস-জীবন নিয়ে মরণোত্তরকালে প্রকাশিত বিতর্কিত স্মৃতিগ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশিত হলে তা আবার নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করে। হেমিংওয়ের জীবনের এ ধরনের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে এই বইয়ে চারটি গবেষণালব্ধ রচনা সন্নিবেশিত হয়েছে, যা পাঠে রমণীমোহন, দুঃসাহসী ও শক্তিশালী এই সাহিত্যিক প্রতিভা ও বিতর্কিত মানুষটিকে চেনা যাবে।
উর্দু-ফারসি কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে এ উপন্যাস। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে সর্বস্ব হারানো এক রাজপুত তরুণ রুসওয়া, যার আজন্ম সাধ মির্জা গালিবের দর্শন পাওয়া। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে সে কানপুর থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হয়। ধ্বংসস্তূপ দিল্লিতে কবির সঙ্গে তার দেখা হয়। ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে রুসওয়ার চোখে দেখা তখনকার দিল্লি, সেখানকার যমুনাঘাট, চাঁদনি চওক, জামা মসজিদের বাজার আর সাবেকি দিল্লির সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের পাঠকের পরিচয় ঘটাবে এ বই। গালিব নিজেকে বলেছেন অনেক দূরের নক্ষত্র। তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য আর উচ্ছলতার সঙ্গে অদ্ভুত এক উদাসীনতার ছবিও ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে। সঙ্গে আছে গালিবসহ অনেক কবির মনোগ্রাহী বেশ কিছু শের।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি আর শিল্পায়নের পথে জাপানের গর্বিত অগ্রযাত্রার শুরু। এই অগ্রগতির রহস্য বুঝতে জাপান দেশটিকে ও তার জনমানসকে নিবিড়ভাবে চেনা ও বোঝা দরকার। এ বইয়ে লেখক মনজুরুল হক তাঁর দীর্ঘ জাপানবাসের অভিজ্ঞতার আলোকে সেই চেষ্টাই করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে জাপান হূদয়ের খুব কাছের দেশ হলেও, তার প্রকৃত পরিচয় যেন অনেকটাই আড়ালে ঢাকা। এর কারণ সম্ভবত জাপান সম্পর্কে বাংলা ভাষায় লেখা বইয়ের তুলনামূলক ঘাটতি। বিংশ শতাব্দীর মধ্য-পাঁচের দশক থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি আর শিল্পায়নের পথে দেশটির গর্বিত অগ্রযাত্রার শুরু। তবে অর্থনৈতিক অগ্রগতির এই প্রবাহের নিচে জাপানের সাহিত্যিক, শৈল্পিক ও নান্দনিক উত্কর্ষ এবং আধ্যাত্মিক আবেদনের ধারাটি চাপা পড়েনি। এমন যে জাপান, সেই জাপানকে ভালোভাবে বুঝতে হলে দরকার তাকে অতি কাছ থেকে সুনিবিড়ভাবে দেখা ও তার ভেতরের সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করা। জাপানে তাঁর দীর্ঘ প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে এ বই লিখতে গিয়ে লেখক মনজুরুল হক সেই চেষ্টাই করেছেন। সুযোগ হয়েছে তাঁর সে দেশের সব কটি জেলা সফরের। দেশটির নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছেন। সে তালিকায় যেমন আছেন দেশটির সম্রাট, তেমনি পার্ক কিংবা রেলস্টেশনে কার্ডবোর্ডের বাক্সে সংসারজীবন যাপন করা গৃহহীন মানুষ। সমৃদ্ধ সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে জাপানে তাঁর বসবাসের প্রথম দেড় দশকের নির্যাস লেখক তুলে ধরেছেন এ বইয়ে। একবার পড়তে শুরু করলে পাঠক একনিশ্বাসে তা শেষ না করে থাকতে পারবেন না।
আনোয়ারা সৈয়দ হকের গল্পগুলোতে উঠে এসেছে মানবজীবনের বিচিত্র দিক। মানুষের জীবনে প্রেম আসে। আসে দুঃখ, নানা সমস্যা-সংকট। আর এসব বয়ে ও সয়েই বেঁচে থাকতে হয় মানুষকে। গ্রন্থভুক্ত কোনো কোনো গল্পের আত্মজৈবনিক অনুষঙ্গ পাঠককে নিয়ে যাবে গল্পকারের নিজের অভিজ্ঞতার গভীরে। পাশাপাশি সমাজে নারীর ভঙ্গুর অবস্থান ও সংগ্রামের অন্তর্জগৎও উঠে এসেছে কোনো কোনো গল্পে। করোনা অতিমারির কালে মানুষের জীবন হয়ে পড়েছিল বিপর্যস্ত। এ সময় আমরা হারিয়েছি আমাদের নিকট ও ঘনিষ্ঠ অনেককে। এক ভীতিকর পরিবেশের মুখোমুখি হয় সবাই। প্রিয়জনকেও তখন ছঁুয়ে দেখতে পারে না। অংশ নিতে পারে না তার অন্তিম যাত্রায়। সাংসারিক টানাপোড়েন, মৃত্যুশোক, না পাওয়ার বেদনা—এগুলো কি মানুষ কখনো কাটিয়ে উঠতে পারে? সব সংকট উতরে কি শেষ পর্যন্ত গাওয়া যায় জীবনের জয়গান? এককথায় বলা যায়, জীবনসংশ্লিষ্ট এসব বিষয় নিয়েই এই বইয়ের গল্পগুলো।
ড. কামাল হোসেন আমাদের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক কালপর্বের প্রত্যক্ষদর্শী। কখনো নেপথ্যে আবার কখনো প্রকাশ্যে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষের অন্যতম আইনজীবী। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সাংবিধানিক পরামর্শদাতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের তরফে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনায়ও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোগী। তাঁরই নেতৃত্বে প্রণীত হয় বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি স্থাপনে বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইতিহাসের সেসব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—জানা-অজানা নানা তথ্য ও ঘটনা গ্রন্থভুক্ত কামাল হোসেনের দীর্ঘ দুটি সাক্ষাৎকারে সবিস্তার উঠে এসেছে। এ ছাড়া গ্রন্থের অন্য লেখকেরাও তাঁদের রচনায় নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে ও বস্ত্তনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের জন্ম ও বিকাশে ড. কামাল হোসেনের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাস জানতে ও বুঝতে পাঠককে সহায়তা করবে এ বই।