হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো একটি সূক্ষ্ম পুষ্পরেণুও কোনো কোনো মানুষের দৃষ্টি এড়ায় না। সবুজ ঘাসের পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু আর অবাক মেঘের উড়ানে কেউ কেউ খুঁজে পান জীবনের সুন্দরতম অবয়ব, নিজের পরিপাটি ভুবন রেখে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন সময়ের ঘাত-প্রতিঘাত। মানুষের দৃষ্টিসন্ধিতে জমে থাকা পরশপাথরও চুর চুর করে ভেঙে পড়ে তার জাদুকরী আঙুল স্পর্শে। তেমনই অন্তদ অন্তর্দৃষ্টি আর মমতায় জীবনের গল্প রচে চলেন গল্পকার স্মৃতি ভদ্র। পালক নরম শব্দের বুনন, দুর্দান্ত কল্পনাশক্তি আর নিগূঢ় মমত্ববোধ দিয়ে গল্পকার স্মৃতি ভদ্র 'এলেনা বেলেনা' গল্পগ্রন্থের ষোলোটি গল্প নির্মাণ করেছেন। এই গল্প- সংকলনের গল্পগুলোতে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের নানা অবক্ষয় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
দ্যুতিবিথার’-এর কবি বেনজির শিকদার নতুন প্রজন্মের একজন প্রাগ্রসর প্রবিশ্ববাঙালি। সৃষ্টিশীলতা ও নান্দনিক মানবিকতাই তাঁর প্রার্থিত জীবনাচার। কবিতার জন্য যে অনুপ্রাণিত অনুভূতি ও সচেতন নির্মিতি প্রয়োজন, তা আয়ত্তের নিমিত্তে এই কবি নিরন্তর সচেষ্ট। এ-ক্ষেত্রে বাণী ও অলঙ্কৃতির যুগোপযোগী নবায়নই তাঁর মুখ্য অন্বিষ্ট । বাঙালি বেনজির নস্টালজিক স্মৃতি ও মানবিক শেকড়ময়তায় উৎস-সন্ধানী। বাংলা ভাষার মুখ্য তিন ছন্দে তিনি সচ্ছন্দ, আবার স্বোপার্জিত কথন-গদ্যেও সাবলীল। শব্দকে নতুনতর অভিধায় উন্নীত করার কাজেও তিনি সচেতন। মায়াগ্রামের অনন্তচাঁদ তাঁর পিছু ছাড়েনি; ছাড়ে না কোনো প্রকৃত কবিকেও। তাই তাঁর হাতে তৈরি হয় নটেশ্বর-নবকুমার’-এর মতো চিত্রধ্বনিময় রূপকল্প। আমি ঐতিহ্যসিক্ত ও নবাধুনিক এই কবির উত্তরোত্তর নান্দনিক সাফল্য কামনা করি।
you loved me for an hour But only with your eyes Your lips I could not capture By storm or by surprise suddenly I am sad Day and night, it haunts me The kiss I never had.
ইলগে মানে নীল অপরাজিতা - নিছক একটি ভ্রমণকাহিনি নয়। ভৌগোলিক ভ্রমণ ছাপিয়ে এ বই হয়ে উঠেছে একজন বাঙালি নারীর আত্মোন্মোচনের খসড়া। এর পরতে পরতে, শব্দের স্বতঃস্ফূর্ত গতির প্রবাহে লেখক ঘুরিয়ে আনেন সুইজারল্যান্ড আর জার্মানির নদী, শহর, শহরতলি আর গ্রামের পায়ে হাঁটা পথ। তবু এ কেবল ঘুরে বেড়ানোর গল্প নয়। জনান্তিকে, অন্তর্লীন সত্তায় আমরা ভ্রমণ করে আসি পৃথিবীর অতীত ও বর্তমানের অলিগলি। লেখক আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন প্রকৃতি আর মানুষের সঙ্গে সে মানুষ জাতি-দেশের বাইরের বিশ্বমানুষ। আর তার অন্তরাল দিয়ে লেখক শুনিয়েছেন অনিবার্য সত্যের মতো সংলিপ্ত হয়ে থাকা ইতিহাস। দৃশ্যের বিপরীতে তৈরি করেছেন আরেকটি বিমূর্ত দৃশ্য। কখনো প্রত্যক্ষতাকে ছাপিয়ে তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন পুরাকালের বাস্তবতায়। আমরা বিমূঢ় বিস্ময়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করে ফিরে এসেছি রাইন নদীর পাড়ে। এ নিছক সাতদিনের ভ্রমণ নয়, সাতদিনের ছুতোয় আমরা ঘুরে এসেছি এক শতাব্দীকাল।
বইয়ের গল্পগুলো নানারকম মানুষের গল্প। নানান শ্রেণিপেশার মানুষ। কেউ উঠে এসেছে বাংলার কাদা মাটি থেকে। কেউবা আফ্রিকার কোনো দেশ থেকে। তাদের কেউ মার্কিন মুলুকের অভিবাসী। কেউবা নিজ ঘরে পরবাসী। এই বইয়ের সুবাদে সেই সব চরিত্রগুলো এসে দাঁড়িয়েছে একই আঙিনায়। বিশ্বাস করি, গল্পগুলো গড়তে পড়তে পাঠকরাও মিলিত হওয়ার সুযোগ পাবেন সেইসব চরিত্রের সাথে। যেন বহুদিন পরে দেখা হবে কোনো বন্ধুর সাথে। দূর গাঁয়ের কোনো চেনা মানুষের সাথে। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠবে ফেলে আসা জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার গল্প। নবীন কিশোর খুঁজে পাবে কোনো নতুন মুখ। এ যেন এক পৌষ-ফাগুনের মেলা। আমাদের খুবচেনা কোন ভুবনডাঙার মাঠ। যেখানে পসরা বসে স্বপ্ন বেচাকেনার। যেখানে ধুলোই ওড়ে বিষণ্ণতার বেলুন। সে বেলুনের সুতো যে কার হাতে বাঁধা তা আমরা জানি না। তাকে আমরা খুঁজতে থাকি গল্পের আখ্যানে। খুঁজতে খুঁজতে আমাদের সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। আমরা পৌঁছে যায় আরেক বিষণ্ণ সময়ে। তখন আমাদের গল্পগুলো হয়ে ওঠে বিষণ্ণ সময়ের গল্প। যে সময় আমাদের দূরত্বের কথা বলে। বিচ্ছিন্নতার কথা বলে। কথা বলে একাকিত্ব আর হতাশার। গল্পগুলোতে বেজে ওঠে ঝরা পাতার বাঁশি। এই বিষণ্ণ সময়ের গল্পগুলোর মাঝে মানুষের সামনে আশার হাত বাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন লেখক। যাতে তারা বুঝতে পারে তুমি নও একা'। সবকিছু মিলিয়ে গল্পগুলো পাঠকপ্রিয় হবে বলেই বিশ্বাস করি।
ফ্ল্যাপ ইনফো: কবি হোসাইন কবিরের বলার কথা অনেক। বলেও ফেলেন অনায়াসে কখনও শব্দচিত্রে সরাসরি, প্রায়শই ঈষৎ তির্যকভঙ্গিতে। তিনি গভীর যন্ত্রণার দাহ ব্যক্ত করেন ভাবের বিচিত্রতায়, ভলোবাসার আবেগ বিধৃত করেন নৈসর্গিক জাদুমিশ্রিত অন্তরঙ্গতায়। অকারণ ইন্দ্রিয়চেতনার প্রশ্রয় দেন না। জীবনের গভীরতর বোধকে উন্মোচন করেন বাকপ্রতিমার সৌন্দর্যে ও শব্দবিন্যাসের সাবলীলতায়। হোসাইন কবিরের কবিতা আত্মগত চেতনার সঙ্গে সমাজবোধের উদ্বাহবন্ধন। সৌন্দর্য ও মঙ্গলে বিশ্বাস তাঁর কবিতার কেন্দ্রভূমি। এখানে থেকে কখনও কেন্দ্রাভিগ কখনও কেন্দ্রাতিগভাবে আবর্তিত হয় তাঁর চিন্তা। বাচনের তীক্ষ্মতা, ছন্দের প্রচলিত গতিবিরুদ্ধতা ও চিত্রকল্প রচনার সৌন্দর্য তাঁকে দিয়েছে সতন্ত্র ঘরানার কবি' অভিধা। দশক বিবেচনায় হোসাইন কবির আশি'র দশকের কবি। 'ও মাটি ও শূন্যতা' তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
বাংলা সাহিত্যে কবিতা, গল্প বা উপন্যাসের পাশাপাশি ভ্রমণবিষয়ক রচনা তুলনামূলকভাবে কম। সাম্প্রতিককালে শিক্ষা, ব্যবসা ও শখের কারণে স্বদেশ ও বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ বেড়েছে। আর সেই সঙ্গে গতি পেয়েছে ভ্রমণ সাহিত্যের চর্চা ও বই প্রকাশ। ভ্রমণ বিষয়ে বই প্রকাশনা বৃদ্ধি পেলেও গুণমান-সমৃদ্ধ বইয়ের অভাব সহজেই চোখে পড়ে। সেই অভাব পূরণে এগিয়ে এসেছেন ভ্রামণিক স্বপন বিশ্বাস। সচরাচর ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখায় স্থান-কাল-পাত্রের বর্ণনা প্রাধাণ্য পায়। তিনি কেবল বর্ণনাকে প্রাধাণ্য না দিয়ে কোনো একটি বিষয়বস্তুর ওপর ফোকাস করেছেন; করেছেন অনুসন্ধান। তাই বিষয়বস্তুর সঙ্গে ওঠে এসেছে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অনেকটা গল্প বলার ধাঁচে তিনি হাজির করেছেন সেই বিষয়ের বিবরণ। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে লেখক দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন; সেই সত্যের প্রতিফলন ঘটেছে 'কুড়াই পথের নুড়ি' বইয়ে। বাংলা সাহিত্যে এই বই অভিনব সংযোজন বলে মনে করি।
প্রবাস আর শেকড়ে অবস্থান করে, জীবনযাপনের এক প্রান্তে তথ্য-তাড়িত দ্রুতলয় পৃথিবীর ক্লান্ত অবসন্ন পালাবদলের সুতীব্র দাবদাহ আর অন্য প্রান্তে শেকড়ের সহজিয়া কাব্যসুষমার আদিম মাদকতার নান্দনিক তৃষ্ণার মনোজগতপ্রসূত এক কাব্যকলার শিল্পবোধ নির্মাণ করে চলেছেন কবি হোসাইন কবির। জীবনের বহুমাত্রিক গভীরতম বোধে স্নাত শব্দ আর অপূর্ব চিত্রকল্পের সিম্ফনিতে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে মানুষ আর প্রকৃতির কাঙ্ক্ষিত শিল্পিত অবয়ব। শব্দে চিত্রে দৃশ্যকল্পে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের কবি, দশক বিবেচনায় আশির দশকের। নিঃসঙ্গ পাতার বাঁশি তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ।
পর্বত-কন্যা কাকন বিবি সমাজের অবহেলিত বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষদের একজন, জীবনের চলার পথে তাঁকে বহু বাধা বিঘ্ন মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। পার্বত্য জাতিসত্তার সদস্য হিসেবে রূপ-লাবণ্যে তিনি অনেকের দৃষ্টি কেড়েছেন, আবার দরিদ্র অবহেলিত নারী হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কালো থাবা তাঁর দিকে প্রসারিত হয়েছে বারবার। বিচিত্র তাঁর জীবন-কথা, তার চেয়েও কঠিন তাঁর জীবন-যুদ্ধ। নির্যাতিত হয়েছেন একাত্তরে, যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, শত্রু শিবিরে প্রবেশ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে, আবার মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর হারিয়ে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। অনেক বিলম্বে হলেও এক সময় উদ্ভাসিত হয় তাঁর বীরত্ব-গাথা, সংবর্ধিত হন তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান রাষ্ট্রের তরফ থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পান ঊষ্ণ ভালোবাসা। অখ্যাত অজ্ঞাত এই বীর নারীর জীবন-ভাষ্য রচনা করেছেন একনিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। কঠিন সেই দায়িত্ব দক্ষতা ও মমতার সাথে পালন করেছেন তিনি। কাকন বিবির জীবনের পূর্বাপর এই বয়ান তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের আলোড়িত করবে নিশ্চয়, সেই সঙ্গে আলোকিতও।