মা যখন টুপ করে মরে গেলো আর কাপড়ের পুটুলিতে পেঁচানো মাংসের দলার মতোন মনুকে রেখে গেলো এইটুকু, তখন থেকেই পাখি জানত, তার জন্ম অন্যের ভার কাঁধে নিয়ে চলবার জন্য। কিন্তু তার ভার বইবার এ জগতে কেউ নেই। এই নিয়ে পাখির যে খুব আক্ষেপ ছিল তাও নয়। বরং এসবে তার অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিলো। কতদিন ভাতের হাড়ির শেষ ভাতটুকু বাবা আর মনুকে খাইয়ে নিজে ঢকঢক করে দু মগ পানি গিলে বিছানায় শুয়ে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই! পাশে থাকা বাবা কিংবা মনু তা কখনো টেরই পায়নি। অথচ, সেই পাখিই কিনা বশিরকে পেয়ে লতার মতো এলিয়ে যাচ্ছিল। এই ভালো লাগার অনুভূতির সঙ্গে এর আগে কখনো পরিচয় ছিল না তার। কারণ, পাখি জানত- যে মেয়েটি রাস্তা পার হওয়ার সময় শক্ত কারো হাত খোঁজে, বোতলের ছিপি খুলে দেওয়ার জন্য দৃঢ় কোনো আঙুলের সাহায্য চায় কিংবা আলতো অভিমানে কেঁদে বুক ভাসায়, আর দুঃখ পেলেই লুকাতে চায় কারো চওড়া বুকে, লতার মতো এলিয়ে পড়ে পাশে থাকা পুরুষ বৃক্ষে- সে মোটেই তেমন নয়। দুঃখ ভুলতে কাউকে লাগে না তার। সে নিজেই নিজের আশ্রয়। যতটুকু ওজন তার, তা সে বয়ে নিতে জানে। জানে বাড়তি খানিক কাঁধে তুলে নিতেও। কারণ, জীবন তাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জীবন জানত না, সে সেই পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের ভেতর থেকে জেগে ওঠা ফিনিক্স পাখি! হার না মানা: আগুনডানা: মেয়ে।
‘এই ঘটনা সত্য, না মিথ্যা? ‘মিথ্যা’। মিথ্যা ঘটনা লিখেছেন কেন? ‘সরি, এটা আসলে সত্য ঘটনা। ‘সত্য ঘটনা এমন হয়? এমন কেন? এই প্রশ্নে আমি চুপ করে থাকি, আমার কষ্ট হয়। আসলেই কী জীবন এমন? হয়তো এমনই, হয়তো এমন নয়। তবে আমি সবসময়ই বলি, ‘জীবনে যেমন গল্প থাকে, তেমনি গল্পেও থাকে জীবন। সেই সব গল্পের কতটুকুই আমাদের জানা থাকে? আমরা কতজন কত কত নিঃসঙ্গ দিন-রাত্রির গল্প বুকে পুষে কাটিয়ে দেই একাকি জীবন, সেই জীবনের খবর কে রাখে? হয়তো সেই নিঃসঙ্গ মানুষটি ছাড়া আর কেউ-ই না। ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্ৰ’ তেমনি গল্প কিংবা জীবন। এই গল্পটা কী কোথাও শুনেছি আমি? আমার ধারণা আমি শুনেছি। গল্পের মেয়েটার মুখ থেকেই শুনেছি এবং মেয়েটিকে চিনিও আমি। কিন্তু গল্পটা কী একটু অন্য রকম হয়ে গেল? নাকি আরো খানিকটা অন্যরকম হতে পারতো? অনু কী জানতে পারতো না, জীবন কেবল এমন নয়, জীবন হতে পারে আরো অন্যরকমও? কলম অবশ্য বলে গেল, কেউ জানে না জীবন কেমন, জীবনের রকম কী! তা কেবল জীবনই জানে। তাই সে লিখে গেল জীবন। সেই জীবন সত্য না মিথ্যা, তা ধরতে পারে সাধ্য কার! ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’ সেই সত্য-মিথ্যার জীবন।
প্রেসক্লাবের সামনের ভিড় বাড়তে বাড়তে চলে এসেছে রাস্তা অবধি। অফিসফেরত বাসযাত্রীদের বাসগুলো আটকে পড়েছে। ফলে রাস্তার জ্যাম ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কৌতুহলী মানুষ তাদের জরুরি কাজ ফেলে ভিড়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পেছন থেকে সামনের ঘটনার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফলে কেউ কেউ উঠে গেছে। ওভারব্রিজের ওপরে। দু-একজন তরতর করে রেইনট্রি গাছের ডাল বেয়ে উঠে গেছে। আশপাশের বাসা, অফিসের ছাদেও উৎসুক। মানুষের ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা কী? ঘটনা হলো ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়ানো শীর্ণকায় শরীরের মানুষটা। তার নাম আজিজ মাস্টার। আজিজ মাস্টার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসক্লাবের সামনে। তার বাঁ হাতে ধরা একখানা মশাল। আর কিছুক্ষণের চণের মধ্যেই তিনি সেই মশাল থেকে গায়ে আগুন ধরাবেন। কিন্তু একটু দেরি করছেন। কারণ তার গলায় একখানা ছোট ব্ল্যাকবোর্ড ঝোলানো। সেই ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে স্পষ্ট বড় বড় অক্ষরে লেখা, 'আমিই কোহিনুরের বাবা...'
১ম ফ্ল্যাপ বিকেলের দিকে হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। হৃদি তখন খোলা মাঠে একটা শুকনো খড়ের গাদার ওপর বসেছিল। যতদূর চোখ যায়, কোথাও কেউ নেই। কেবল ধুধু ফসলের মাঠ। মাঠের পাশে নদী। নদীর বুকে শব্দ। সেই শব্দে নুপুরের ছন্দ তুলে নেমে এল বৃষ্টি। হৃদি তটস্থ গলায় বলল, 'এখন? এখন কী হবে?' 'কী হবে?' 'এই যে বৃষ্টি চলে এল।' 'তাতে কী?' আমি এই ভেজা শাড়িতে ফিরব কী করে? 'ফিরতে হবে না।' বলে হৃদির বুকের কাছে এগিয়ে গেল অনিক। তারপর দুহাতে আঁকড়ে ধরল তাকে। বলল, 'তোমার কাজল ধুয়ে যাচ্ছে।' হৃদি কথা বলল না। অনিকের এই কথা, এই কণ্ঠস্বর, নদী, মাঠ, বৃষ্টি সবই তার ভালো লাগছে। কিন্তু এখান থেকে ফেরার চিন্তা তাকে আড়ষ্ট করে রাখল। অনিক হঠাৎ তার ঘাড়ের কাছের ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল, 'বৃষ্টি এলেই তোমার চুলে খানিক ভুলে গন্ধ নেব তোমার ঠোঁটেই খুঁজব নেশা, নিকোটিনটা বন্ধ দেব বেহিসেবি হাটবাজারে ছেড়েই দেব দামাদামি বৃষ্টি এলেই বদলে যাব, আবার হব তোমার আমি।' হৃদি কথা বলল না। সে টলমল চোখে তাকিয়ে রইল। সূর্য লুকিয়েছে অনেক আগেই। মেঘলা আকাশও যেন আগেভাগেই দিনের যবনিকা টেনে দিচ্ছে। কিন্তু হৃদির চোখে, মুখে, বুকে জ্বলে রইল আশ্চর্য দ্যুতিময় এক আলো! সন্ধ্যার অন্ধকারের সাধ্য কী সেই আলো নেভায় ?
"তোমার নামে সন্ধ্যা নামে" বইয়ের ভূমিকার থেকে নেয়া: উপন্যাসটি লেখার পেছনের ঘটনা মজার। পাক্ষিক অন্যদিন পত্রিকার ঈদসংখ্যার জন্য গত ক বছর ধরে প্রতিবারই একটি উপন্যাস লিখি আমি। সেই উপন্যাসই পরবর্তীসময়ে অন্যপ্রকাশ থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এবারও লিখছিলাম। কিন্তু উপন্যাসটি শেষ করা হয় নি। শেষ না করার কারণ মহামারি করোনা। করোনার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এবার অন্যদিন ঈদসংখ্যা বের হলো না। কিন্তু এই খবর যতদিনে জেনেছি, ততদিনে উপন্যাসের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লেখা শেষ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লেখা জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় লিখতে হচ্ছিল একটান। দমবন্ধ পরিস্থিতি। ঠিক সেই মুহুর্তে পত্রিকা বের হচ্ছে না শুনে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ল্যাপটপ বন্ধ করে মনের আনন্দে অবসর কাটাতে লাগালাম। তারপর দীর্ঘসময় কেটে গেল। মাথা থেকে হারিয়ে গেল এই উপন্যাসও। কিন্তু হঠাৎই একদিন অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম বললেন, 'উপন্যাসের কী খবর? আমি চমকে উঠে বললাম, কোন উপন্যাস?' তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমি ল্যাপটপে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, সেই ফাইল আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কী নামে সেভ করেছিলাম তা-ও মনে নেই। বহু তত্ত্ব-তালাশের পর অবশ্য সেই ফাইল খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু ততদিনে উপন্যাসের অসমাপ্ত অংশের কী গল্প আমি ভেবে রেখেছিলাম, চরিত্রগুলোর পরিণতি কী হবে, সমাপ্তি কী, এসবই আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছি। ফলে লেখাটা আবারও পড়তে হলো। একবার, দুবার, বহুবার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বহুবার পড়তে গিয়েই নতুন গল্প মাথায় চলে এল। তবে তা আগের লেখা বাদ দিয়ে নয়। বরং সেই আগের লেখার সঙ্গেই যুক্ত হলো নতুন ঘটনা-প্রবাহ, নতুন সূচনা-সমাপ্তি, সঙ্গে দারুণ কিছু চরিত্রও। কিন্তু এতে কি গল্পের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাঠক দিতে পারবেন না। কারণ, তারা সেই প্রথম অংশ পড়ার সুযোগ পান নি। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, 'তোমার নামে সন্ধ্যা নামে'র শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। -সাদাত হোসাইন
দুই বাংলার পাঠকদের কাছে সাদাত হোসাইনের অবস্থান অনেকটা 'এলেন, লিখলেন, জয় করলেন'-এর মতো। তার একটি উপন্যাস পড়েছিলাম, এক সাহিত্য পুরস্কারের হ্রস্ব তালিকায় সেটি স্থান করে নেওয়ার পর। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বইটি পুরস্কার পায় নি। এজন্য নিশ্চয় তার মন খারাপ হয়েছে, কিন্তু সেই ভাবটা চেপে রেখে বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বলেছে, তার দুর্বলতার জায়গাগুলি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। কিছু কথা তাকে বলেছিলাম, সে মন দিয়ে শুনেছে। আমি নিশ্চিত, নিজেকে উত্তরণের চেষ্টায় নতুন করে সে নেমেছিল। সফলও যে হয়েছিল, প্রমাণ তার সাম্প্রতিক উপন্যাসগুলো। তার লেখার হাত এখন অনেক শক্তিশালী, ভাষাটা তার স্বাক্ষরযুক্ত, চিন্তাগুলি অনেক পরিণত। তরুণ পাঠকদের সে আকৃষ্ট করে। এবারের কলকাতা বইমেলায় তার সই নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো পাঠকদের ছবি প্রথম পাতায় ছেপেছে কলকাতার বাংলা কাগজ। এক পাঠক বলেছে, সাদাতের লেখায় সম্মোহনী শক্তি আছে